হিজরত, মুহাররাম ও আশুরাঃ আমাদের করণীয়

সুপ্রিয় ভাই ও বোন, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। আশা করি সবাই আল্লাহর অশেষ রহমতে ভাল আছেন। আপনাদের সবাইকে জানাচ্ছি ইসলামী ক্যালেন্ডারের হিজরী নববর্ষের শুভেচ্ছা। হিজরী বৎসরের প্রথম মাস মুহাররামে আপনাদের জানাচ্ছি স্বাগতম। পাশাপাশি বিগত বছরকে বিদায় প্রাক্কালে আপনাদের সকলের জন্য আল্লাহর তালার কাছে ক্ষমা কামনা করছি। আরো কামনা করছি এই মুহাররাম মাসে আপনাদের জীবন হোক যাবতীয় অন্যায়ের ছায়ামুক্ত এবং ভবিষ্যত দিনগুলো হোক আল্লাহ্‌ তালার আনুগত্য, রাসূলুল্লাহর অনুসরণ এবং যুগের সোনালী পূরুষদের আদর্শে উজ্জীবিত, সুন্দর এবং সুখকর।

মুহাররাম মাস ইসলামের ইতিহাসে এক নব দিগন্তের সূচনা। রাসূল (সাঃ) এর হিজরতের মাধ্যমেই দিন গণনার এই নব সূচনা হয় এবং তৎকালীন পৃথিবীতে শান্তির আবেশ ছড়িয়ে পড়ে। ‘নিশ্চয়ই মহাকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে আল্লাহর বিধানে আল্লাহর কাছে মাস গণনায় মাস বারোটি,তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত,এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান;সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না।’ সূরা আত-তাওবা,আয়াত-৩৬)- সম্মানিত এই চার মাসকে চিহ্নিত করে বিদায় হজের ভাষণে রাসূল সাঃ বলেছেন, ‘তিনটি মাস হলো ধারাবাহিক জিলকদ,জিলহজ ও মহররম,অপরটি হলো রজব।’বুখারি, 2958)।

মুহাররাম মাসের ১০ তারিখই ‘আশুরা’ নামে পরিচিত। আশুরার দিন নফল রোজা রাখার ফজিলত সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে প্রশ্ন করা হলে তিনি ঘোষণা করলেন,‘এ রোজা বিগত এক বছরের গুনাহের কাফ্ফারা হয়ে থাকে।’ (মুসলিম, ১৯৭৬ ও তিরমিজি)- অপর হাদিসে রাসূল সা: এরশাদ করেন,‘রমজানের রোজার পরই আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রিয় হলো মহররম মাসের রোজা।’ (মুসলিম, 1982)- আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূল সাঃ বলেছেনঃ রমযান মাসের পর মুহাররাম মাসে রোযা রাখাই সর্বশ্রেষ্ঠ রোযা পালন যেমনি ভাবে ফরয নামাযের পর তাহাজ্জুদ সর্বশ্রেষ্ঠ নফল নামায। (মুসলিম, ১১৬৩)- ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূল সাঃ কে রোযার রাখার জন্য আশুরার দিন ব্যতীত অন্য কোন দিনকে অধিক মর্যাদা দিয়ে খুজতে দেখিনি। (বুখারী, ২০০৬)।

তবে শাবান মাস এবং আরাফার দিন সম্পর্কে এমন মর্যাদা ও অর্থবহ কিছু হাদীস বর্ণিত আছে যে রাসূল সাঃ শাবান মাসে অল্প কিছু দিন ছাড়া বাকী সবগুলোই রোযা রাখতেন। অনুরুপভাবে আরাফার রোযা পূর্বাপর দুই বছরের গুনাহ মাফ করে। এক্ষেত্রে বাহ্যিকভাবে দ্বন্দ পরিলক্ষিত হলেও প্রকৃতপক্ষে এখানে কোন দ্বন্দ নেই। উভয় বিষয়ের হাদীসের সমন্বিত অর্থ হচ্ছে- রমযানের পর [অধিকাংশ দিনে রোযার রাখার মাস হিসেবে] নফল রোযার জন্য সর্বোত্তম মাস হচ্ছে শা’বান মাস, যেহেতু এটি রমযানের কাছাকাছি। শা’বান মাসের মর্যাদার পর মুহাররাম মাসের রোযা অন্যান্য মাসের চাইতে উত্তম। অপরপক্ষে [আলাদা একদিনে রোযা রাখার মর্যাদার বিচারে] রমযানের যে কোন দিনের পর নফল রোযার জন্য সর্বোত্তম দিন হচ্ছে আরাফার দিন এবং এরপর আশুরার দিন; যেহেতু আরাফার রোযা পূর্বাপর দুই বছরের গুনাহের কাফফারা হয় আর আশুরার রোযা পূর্ববর্তী শুধু এক বছরের গুনাহের কাফফারা হয়।

ইসলামপূর্ব যুগেও এই মাসকে বিশেষ সম্মানের সাথে দেখা হতো। তার কারণ হচ্ছে-রমযানের রোযা ফরয হওয়ার আগে আশুরার রোযা অর্থাৎ মুহাররামের দশ তারিখে রোজযা রাখা ফরয ছিল। যখন রমযানের রোযার বিধান নাযিল হলো তখন থেকে আশুরার রোযাকে নফলের পর্যায়ে আনা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মদিনায় হিজরত করে দেখতে পেলেন যে ইহুদিরা মহররমের ১০ তারিখ আশুরা দিনে রোযা রাখছে। রাসূল (সাঃ) তাদের জিজ্ঞেস করলেন,‘এটা কোন দিন,যাতে তোমরা রোযা রেখেছ?’ তারা বলল,‘এটা এমন এক মহান দিবস, যেদিন আল্লাহ তাআলা হযরত মুসা (আঃ) ও তাঁর সম্প্রদায়কে নাজাত দিয়েছিলেন, ফিরআউনকে তার সম্প্রদায়সহ ডুবিয়ে মেরেছিলেন। তাই হযরত মুসা (আঃ) কৃতজ্ঞতাসরূপ এইদিনে রোযা রেখেছেন,এ জন্য আমরাও রোজা রাখি।’ এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেন,‘তোমাদের চেয়ে আমরা হযরত মুসা (আঃ) এর অধিকতর ঘনিষ্ঠ ও নিকটবর্তী।’ অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) রোযা রাখলেন এবং অন্যদের রোযা রাখার নির্দেশ দিলেন।’ (বুখারি, 1865 ও মুসলিম)

আশুরার রোযার হিকমতঃ
ইবাদতে কিংবা অন্যান্য কাজে ইহুদীদের অনুকরণ না করা বরং তাদের বিরোধিতা করা। (ফাতহুল বারি, ৪/২৪৫)- এই দিনে রোযা রাখার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হচ্ছে- রাসূল সাঃ এর পূর্ববর্তী নবী রাসূলদের আনিত যে সকল বিধান আমাদের জন্য কল্যাণকর সেগুলোর প্রতি স্বীকৃতি ও সম্মান প্রদর্শন। তবে এই সম্মানের কাজ এমন পন্থায় করতে হবে যাতে এটি অন্যান্য জাতির প্র্যাক্টিস থেকে উন্নত হয় এবং তাদের থেকে ভিন্ন হয়। এজন্য রোযার মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এই মহৎ কাজেও ইহুদীদের সাথে সামঞ্জস্যতা না রাখতে রাসুল সাঃ সাহাবাদের নির্দেশ দিয়েছেন এবং তাদের বিরোধীতা সরূপ পরবর্তী বছর থেকে দশ তারিখের আগে বা পরে একটি অতিরিক্ত রোযা রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। এখানে আরো উল্লেখ্য যে এই দিনে রোযা রাখাকে ভাল বিবেচনার করার সাথে সাথেই রাসূল সাঃ এই ভাল কাজকে মিস করলেননা বরং নিজে রোযা রেখেছেন এবং অন্যদের রোযা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। অধিকন্তু রাসূল সাঃ শুধু ভাল কাজের বাস্তবায়ন করেই ক্ষান্ত হননি বরং এই ভাল কাজের জন্য তিনি নিজেদেরকে অধিক হকদার হিসেবে দাবী করেছেন। সাথে সাথে এমন ভাল কাজে যাতে অন্যদের অনুকরণ না হয়ে যায় এবং এর বাস্তবায়নও যাতে অধিকতর উত্তম পন্থায় হয় সেজন্য বেঁচে থাকলে পরবর্তী বছর নিজে দু’টি রোযা রাখার প্রত্যয় নেন এবং সাহাবাগনকেও নির্দেশ দেন।

আশুরার রোযার পন্থাঃ
আশুরার রোযা পালনের চারটি পন্থা রয়েছে। তম্মোধ্যে সর্বোত্তম পন্থা হিসেবে নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ
প্রথমঃ মুহাররামের ৯ ও ১০ তারিখ মোট ২ দিন রোযা রাখা। এটি সর্বাপেক্ষা উত্তম পন্থা।
দ্বিতীয়ঃ ১০ ও ১১ তারিখ মোট ২ দিন রোযা রাখা
তৃতীয়ঃ ৯, ১০, ও ১১ তারিখ মোট ৩ দিন রোযা রাখা
চতুর্থঃ শুধু ১০ তারিখ রোযা রাখা

আমাদের করনীয়ঃ
– যাবতীয় গুনাহের কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখা। অন্যায় ও পাপ কাজের মাধ্যমে নিজের প্রতি জুলুম করতে আল্লাহ্‌ তাআলা বিশেষভাবে নিষেধ করেছেন।
– এই মাসের গুরুত্ব, তাৎপর্য, মর্যাদা, করণীয় ইত্যাদি সম্পর্কে জানা।
– বিশেষতঃ কারবালাকে সম্পরকে মানুষকে এবং নতুন প্রজন্মকে লিখা, বক্তব্য এবং প্রোগ্রানের মাধ্যমে অভিহিত করে ঈমানকে মজবুত করা।
– ইমাম হুসাঈনের ত্যাগকে স্মরণ করে দীনি দাওয়াতে ত্যাগের মানসিকতা তৈরি করা।
– দাওয়াতে দীনের প্রচার ও প্রসারের বৃহত্তম লক্ষ্যের সাথে সাংঘর্ষিক যে কোন কাজকে জলাঞ্জলি দিয়ে রক্তপাত বন্ধের চেষ্টা করা যেমনটি করেছিলেন ইমাম হাসান। তিনি নিজেই খিলাফত থেকে পদত্যাগ করে আমীরে মুয়াবিয়াকে খলীফা হিসেবে মেনে নেন এবং তাঁর ভাই হুসাঈনসহ দুজনই মুয়াবিয়ার কাছে বাইয়াত গ্রহণ করে তার নেতৃত্বের স্বীকৃতি দেন। এর উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের মাঝে রক্তপাত বন্ধ করা এবং মতানৈক্যের অবসান ঘটিয়ে বৃহত্তর ঐক্য ফিরিয়ে আনা। (আত-তারিখ আল-ইসলামী, মাহমুদ শাকের, ৪/ ৭৫)
– রাসূল সাঃ এর হিযরতকে স্মরণ করে যাবতীয় গুনাহ থেকে বিরত থাকতে [হিযরত] করতে সংকল্প করা।
– পুর্ববর্তী জীবনের সকল গুনাহের জন্য আল্লাহর তালার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং এমন অপরাধ ভবিষ্যত জীবনে না করা দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহন করা।
– ভবিষ্যত জীবনে ভাল কাজ করার জন্য আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের সাহায্য কামনা করা।
– আশুরা উপলক্ষে কমপক্ষে দুই (৯-১০/ ১০-১১) দিন রোযা রাখা।
– এই মাসে অধিক সংখ্যক রোযা রাখা। তম্মোধ্যে প্রতি সপ্তাহের সোম-বৃহস্পতি এবং ‘আইয়্যামুল বিদ’ তথা ১৩, ১৪, ১৫ এই তিন দিন রোযা রাখা।
– ইহুদী-খ্রীষ্টানদের অনুকরণ বর্জন করা। এজন্য নিজের দৈনন্দিন কাজ-কর্ম এবং সংস্কৃতির সাথে অন্যদের মিল খুজে বের করে তা পরিহার করা।
– সকল প্রকার অপসংস্কৃতিকে না বলা এবং অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে স্ব স্ব অঙ্গনে জন সচেতনতা সৃষ্টি করা।

আশুরার রোযার শিক্ষাঃ
– যে কোন ভাল কাজের স্বীকৃতি দেয়া বুদ্ধিমান মুমিনের কাজ।
– ভাল কাজে নিজেকে অধিক দায়ীত্ববান এবং হকদার মনে করা।
– ভাল কাজে অন্যদের তুলনায় অধিক অগ্রসরমান হতে হবে।
– উত্তম কাজের পন্থা ও হতে হবে তুলনামূলক উত্তম।
– ইহুদী ও খ্রীষ্টানদের অনুকরণ করা যাবেনা। এক্ষেত্রে উভয়ের কাজ এক রকম হলেও তাদের অনুকরণ এড়িয়ে চলতে এবং কাজের পন্থাও হতে হবে ভিন্ন। শুধু তাই নয় বরং ভাল কাজে অন্যদের প্রতিযোগী হিসেবে বিবেচনা করে তাদের থেকে অধিকতর উত্তম পন্থায় এমন ভাল কাজের বাস্তবায়ন করতে হবে।
– প্রতিটি কাজে নিজের মাঝে এবং অন্য জাতির মাজে পার্থক্য খুজে বের করা এবং নিজের কাজের মান আরো উন্নত করা।
– অন্য জাতির স্বভাব-চরিত্র, অভ্যাস, কৃষ্টি-কালচারের অনুকরণ থেকে বিরত থাকা।
– অন্যজাতির মাঝে মানব কল্যাণের কোন দিক পরিলক্ষিত হলে সেটিকে নিজেদের উপযুক্ত করে প্র্যাকক্টিস করা এবং অধিকতর উত্তম পন্থায় করা।

তাই আসুন,আমরা আল্লাহর দরবারে আকুল প্রার্থনা করি,তিনি যেন আমাদেরকে এই মুহাররাম মাসের ঐতিহ্য,গুরুত্ব ও মর্যাদা অনুধাবন করে ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে তার অশেষ রহমত ও করুণা অর্জনে তাওফিক দান করেন এবং সেই সঙ্গে ঐতিহাসিক কারবালার মর্মস্পর্শী ঘটনা স্মরণে প্রতিটি মুসলমানকে ঈমানি চেতনাশক্তিতে আরও বেশি বলীয়ান ও তেজোদীপ্ত হওয়ার মানসিকতা দান করেন। আমিন। ভালো লাগলে লিখাটি শেয়ার করুন।

About আবু তালিব মোহাম্মদ মোনাওয়ার

A peaceful Muslim appreciates diversity and co-existance in Humanity, believes in tolerance and peace.
This entry was posted in ইবাদাত. Bookmark the permalink.

2 Responses to হিজরত, মুহাররাম ও আশুরাঃ আমাদের করণীয়

  1. Mohammad abu hurayta says:

    Apni ekta masa Allah. …

  2. Md. Sajid Hasan says:

    আল্লাহ উত্তম প্রতিদান দিক

Leave a comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.